ভিন্ন স্বাদের চার
-সুস্মিতা সাহা
ভালোবাসার পাশেই (১)
“ওহ্…মম্ ,টুডে দ্য ফিশকারি ইস জাস্ট অসম”…টিংকার কথা শেষ হতে না হতেই আঙ্গুল চাটতে চাটতে রণিত বলে উঠলো-“রিয়েলি অল দ্য আইটেমস্ আর সুপার্ব টুডে”….
সত্যিই আজ রণিত মনিদীপা আর ওদের একমাত্র ছেলে টিংকার ফ্যামিলি টাইমটা একেবারে সুপার হিট হয়ে গেলো। সপ্তাহের এই একটা দিন অর্থাৎ শনিবারের ডিনারটা ওরা তিনজনে একসাথে হৈচৈ করে এনজয় করার চেষ্টা করে…তা সেটা রেস্তোরাঁতেই হোক্ বা বাড়িতে। ভোজনরসিক রণিত অবশ্য খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে রেস্তোরাঁর ওপরেই বেশি নির্ভরশীল। মনিদীপার রান্নার ওপরে অতটা ভরসা করা যায় না। যদিও মনিকে একেবারেই দোষ দেওয়া যায় না। ওর কেরিয়ার এবং সেই সংক্রান্ত ব্যস্ততা কিছু কম নয়। একটি বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কম্পানীর বড়সড় অফিসার মনিদীপা, রণিতেরই মত ।
তবে আজকের সব ব্যাপরটাই যেন আলাদা। আজ মনিদীপা ডাইনিং টেবিলটা সাজিয়েও ছিলো দারুণ সুন্দর করে। আর খাবারগুলো ? কি জানি কোন্ ম্যাজিকের গুণে আজকের প্রত্যেকটা আইটেমই হয়েছিলো লা-জবাব। বিশেষ করে বেকড্ পমফ্রেট আর চিংড়ির মালাইকারীটা যেন একেবারে….
খেতে বসে ছেলে আর স্বামীর কাছ থেকে প্রশংসা পেতে পেতে মনিদীপা ঘেমে নেয়ে একাকার। ওর চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো…
অনেকদিন পরে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আজ মনিদীপা একটা কবিতার বই খুলে বসলো…সত্যিই বহু বছর পরে। আজ গোটা দিনটাই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো…
আজ দুপুরে মনিদীপার প্রিয় বান্ধবী সুনয়না এসেছিলো। সেই স্কুলজীবন থেকে ওদের বন্ধুত্ব। সুনয়না একটা স্কুলে সাহিত্য পড়ায়। সেই সাথে যাবতীয় নান্দনিক কাজে মেয়েটার তুখোড় প্রতিভা। মনিদীপা তার জীবনের যত ব্যথা,আনন্দ,গোপন কথা নির্দ্বিধায় নয়নের কাছে জমা রাখতে পারে…কারণ ও জানে-এর থেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথাও নেই । সত্যিই সে বান্ধবীকে বড় ভালোবাসে এবং ওর সমস্ত গুণ ও প্রতিভার কদর করে।
সুনয়নাও বোঝে মনির বড় ব্যস্ত জীবন…নিজের হাতে রান্নাবান্না করার অবকাশই পায় না। মাসীমা মেসোমশাই চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটার ‘বাপের বাড়ি’বলে আর কিছু নেই। তাই প্রত্যেকবারের মত আজও ও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো নিজের হাতে রান্না করা দারুণ সব খাবার…মনি, রণিত আর টিংকার জন্য।
কিন্তু আজ কি যে হলো…আজ প্রথমবার এমন হলো…
সন্ধ্যেবেলা ডিনার টেবিলে বসে রণিত আর টিংকার মুখে খাবারগুলোর অত প্রশংসা শুনতে শুনতে মনিদীপার কিছুতেই ওদের জানাতে ইচ্ছে করলো না যে – আজকের প্রতিটি আইটেমই সুনয়না বানিয়ে নিয়ে এসেছে। ও চুপ করে রইলো। কেন যে বলতে ইচ্ছে করলো না …কে জানে ? মনিদীপার নিজেকেই বড় অচেনা লাগছে…
কিছুতেই ঘুম আসছে না…। কবিতার বই এর পাতা ওলটাতে ওলটাতে যে কবিতাটায় মনির চোখ আটকে গেলো , তার প্রথম লাইন- “ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে”
নাম তার ঈর্ষা…..
******
(কবিতা-“ভালোবাসার পাশেই”-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
কৃতজ্ঞতা জানালাম
আগামীকাল….হয়তো বা ….(২)
স্যাটেলাইটের মেজাজটা আজ ভালো নেই । ওহ্ নো , ও স্যাড ফীল করছে না ….ওইসব ফীলিংস্ এখন আর নেই। হি ইজ আ লিটল ডিপ্রেসড অ্যান্ড হাইলি ইরিটেটেড । সামার ক্যাম্প এর জন্য ওর ক্লাসমেটরা একটা মুনট্রিপে যাচ্ছে , ওখানে একটা ইন্টার প্ল্যানেট কম্পিটিশন আছে । স্যাটেলাইটেরই শুধু যাওয়া হবে না। ওর বায়োলজিকাল ড্যাড মার্স এ একটা বাংলোবাড়ি কিনছে। সেটার ডিল ফাইনাল করতে ওকেও ড্যাডের সাথে মার্স এ যেতে হবে । উফ্ফ্ রিলেশনশিপের এই প্রেসারগুলো যে আর কতদিন থাকবে …ডিস্গাসটিং লাগে ওর …।
স্যাটেলাইটের সারোগেট মাদার এখন ওর ড্যাডের পার্টনার…শি ইজ রিয়েলি ইনট্রেসটিং…শি ইজ অলসো গোয়িং উইথ দেম । তার কথা ভেবে ক্লাস নাইনের স্যাটেলাইটে একটু উত্তেজিত বোধ করলো ।
এনিওয়ে ,আজ স্যাটেলাইট বড্ড বোর ফীল করছে । এর থেকে হাফব্রাদার টুইটার আর হাফসিস্টার ইন্স্টার প্ল্যানটা অ্যাকসেপ্ট করলেই ভালো হতো । ওরা একটা এল.জি.বি.টি স্কুলের কার্নিভালে যাচ্ছে । ওখানে গিয়ে অ্যাটলিস্ট অনেক এক্সাইটিং গেমস্ এনজয় করা যেত …
স্যাটেলাইটের কিছু ভালো লাগছে না …কিছু না ….হি হেট্স্ দিস প্ল্যানেট …
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কেন যেন আজ ওর বাড়ির একেবারে পেছনের ঘরটায় যেতে ইচ্ছে করলো …
ঘরটা বড্ড অন্ধকার …সেখানে ওর ড্যাডের ড্যাড মানে দাদু একলা থাকেন । হি ইজ ভেরি ওল্ড এন্ড টোটালি ডিফরেন্ট । স্যাটেলাইট ওকে একদম বুঝতে পারে না । হি সিমস টু বি আ স্টোনএজ পারসন । তবুও আজ কেন যেন দাদুর কাছেই একটু গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে …।
দাদু কারুর সাথেই প্রায় কথা বলেন না । সারাদিন ইলেকট্রনিক ডিকশনারিতে কি যেন খোঁজেন ।স্যাটেলাইট একদিন জিজ্ঞেস করাতে ওল্ড ম্যান বলেছিলেন – হি ইজ লুকিং ফর্ আ ওয়র্ড , একটা শব্দ…আ ভেরি ফানি ওয়র্ড ”ভালবাসা” …
স্যাটেলাইট কিছু বুঝতে পারেনি । আর দাদু মাঝে মাঝেই একলা ঘরে শুন্যে হাত মুঠো করে চিৎকার করে বলেন-”যুদ্ধ নয় …শান্তি চাই …সাম্য চাই “- স্যাটেলাইট সেসব কথার মানেও কিছু বুঝতে পারে না …ওহ্ ,দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ সো ডিফিকাল্ট । দাদুকে তখন ওর বড্ড ভয় করে …
তবুও আজ কেন যেন স্যাটেলাইটের শুধু দাদুর কাছেই …
ডাইনিং_টেবিল (৩)
সিক্স সিটার ডাইনিংটেবিল…সেগুন কাঠের। টেবিলটা যখন কেনা হয়েছিল, ছেলে মেয়ে দুজনেই তখন স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। চারজনের সংসারে ফোর-সিটার কিনলেও চলতো। অনিমেষবাবু তবুও ওইটুকু বিলাসিতাকে তখন প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। মাইনে পত্তর যদিও সেই আমলে বিরাট কিছু ছিল না…তবুও।
বড়সড় ডাইনিংটেবিলটা অনিমেষবাবুর মধ্যবিত্ত জীবনে মনের মধ্যে বেশ একটা রাজকীয় ভাব আনতো। দক্ষিণের বারান্দার দিকের চেয়ারটা হয়ে গেলো বাড়ির কর্তার সীট…অলিখিত অবশ্যই।
রবিবার দুপুরে গোটা পরিবারসহ খাওয়াদাওয়ার সময় বারান্দাঘেঁষা চেয়ারটায় বসে অনিমেষবাবু স্বর্গসুখ উপভোগ করতেন…
দেখতে দেখতে কেটে গেল কতগুলো বছর। ছেলে মেয়ে দুজনেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, বিয়ে থাও করেছে। ছেলেবৌমাসহ বাড়িতে আবার চারজন সদস্য। ছুটির দিনে নূতন জামাই আর মেয়ে বেড়াতে এলে সিক্স-সিটার টেবিলটা সত্যিকারের কাজে লাগে। দক্ষিণের চেয়ারটায় বসে অনিমেষবাবু বেশ জমিদারী মেজাজে খাওয়া দাওয়া সারেন। “কর্তামশাইএর সীট” বলে কথা। তার পাউডার মাখা ঘাড়ে সুখের হাওয়া সুড়সুড়ি দেয়…
পেরিয়ে গিয়েছে আরও কয়েকটা বছর। অনিমেষবাবু চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এক নাতি ও এক নাতনিসহ বাড়িতে এখন সদস্য পাঁচজন। অনিমেষবাবুর স্ত্রীর চেয়ারটা গত দুবছর ধরে খালি পড়ে থাকে। মেয়ে জামাই বর্তমানে থাকে বিদেশে। দু বছরে একবার আসার চেষ্টা করে।
বাড়ির বেশিরভাগ আসবাবপত্রই পাল্টে গিয়েছে। তবে সেগুন কাঠের ডাইনিংটেবিলটা একই জায়গায় একইভাবে আছে। দক্ষিণের চেয়ারটা এখনও অলিখিতভাবে বাড়ির কর্তার।
ওটাতে এখন বসে রাজেশ, অনিমেষবাবুর ছেলে…
সম্প্রীতি (৪)
জানালার কাছে দাড়িয়ে দুশ্চিন্তায় ছট্ফট্ করছে জুবেদা । আট বছরের ছেলে ইমরান টা আজই এমনভাবে সাইকেল থেকে পড়ে গেলো …পাশের ফ্লাটের ডেভিড আঙ্কল ইমরানকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে ।জুবেদার আজ যাওয়ার কোনো উপায়ই ছিলো না।
চারতলার ফ্লাটের প্রিয় বান্ধবী দেবলীনার বাবার গতকাল রাতে হার্টঅ্যাটাক হয়েছে । ও চলে গিয়েছে সেখানে,জুবেদার কাছে ছেলের দায়িত্ব দিয়ে। ওর ছেলে দেবমাল্যর আজ স্কুলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। বাচ্চাটার ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে । দেবমাল্যর স্কুলবাসের ড্রাইভার শার্দূল সিং কড়া ধাঁচের লোক । মা দেবলীনা অথবা পাড়ার জুবেদা খালার কাছে ছাড়া সে বাচ্চা ছাড়বেই না …